বিএনপি জোটকে হটাতে যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য চেয়েছিলেন জেনারেল নূরউদ্দীন

এক-এগারো ঘটনাটিকে একটি সামরিক অভ্যুত্থান হিসেবেও দেখেন কেউ কেউ। এখানে সশস্র বাহিনী রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব সরাসরি না নিয়ে সামনে একটা অসামরিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে রেখে পেছন থেকে কলকাঠি নেড়েছে। কয়েক বছর ধরেই এই হস্তক্ষেপের জমি তৈরি হচ্ছিল। বড় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ক্ষমতার স্থূল প্রতিযোগিতা, ব্যক্তিবিশেষের একগুয়েমি, রাজনৈতিক সহিংসতা এবং ধর্মীয় চরমপন্থার উত্থান এ পরিবর্তনের পটভূমি তৈরি করে দিয়েছিল। এ সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য পাওয়া যায় ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত হ্যারি কে টমাসের কাছ থেকে। তিনি ২০০৩ সালের ২৭শে মে থেকে ২০০৫ সালের ২রা জুলাই পর্যন্ত ঢাকায় রাষ্ট্রদূত ছিলেন।

লেখক, গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ ‘১/১১’ শীর্ষক এক লেখায় এসব কথা লিখেছেন।
প্রথম আলো’র ঈদ সংখ্যায় লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে। এতে আরো লেখা হয়েছে, ১৬ই সেপ্টেম্বর ২০০৪ হ্যারি কে টমাস ঢাকা থেকে ওয়াশিংটনের পররাষ্ট্র দপ্তরে একটি তারবার্তার মাধ্যমে জানান যে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাবেক সেনাপ্রধান ও আওয়াম লীগ সরকারের সাবেক মন্ত্রী নূরউদ্দীন খান ক্ষমতাসীন চারদলীয় জোট সরকারের অবসান ঘটিয়ে দুই প্রধান দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের নিয়ে একটি জাতীয় ঐক্যমতের সরকারকে ক্ষমতায় বসাতে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কাছে সাহায্য চেয়েছেন।

সম্প্রতি এক নৈশভোজের সময় তিনি (নূরউদ্দীন) রাষ্ট্রদূতকে বলেন, তিনি ‘উপর্যুপরি গণবিক্ষোভের মাধ্যমে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার হাত থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করতে’ চান। নূরউদ্দীনকে রাষ্ট্রদূত জানিয়ে দিয়েছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্র ও স্থিতিশীলতা চায়, সরকার বদলের জন্য যেকোনো অসাংবিধানিক পদ্ধতি বা সামরিক অভ্যুত্থান সমর্থন করে না। নূরউদ্দীনের অভিযোগ ছিল, প্রধানমন্ত্রীর ভাই মেজর (অব.) সাঈদ এস্কান্দারের সতীর্থদের মধ্যে থেকে সাতজন জেনারেলকে অনুগত মনে করে সেনাবাহিনীর শীর্ষ পদে বসানো হয়েছে। খালেদা জিয়ার প্রথম সরকারের
আমলে (১৯৯১-৯৬) সামরিক বাহিনীতে দলীয়করণ শুরু হয়। শেখ হাসিনার সরকার (১৯৯৬-২০০১) এই ধারা অব্যাহত রাখে। নূরউদ্দীন প্রস্তাব করেন যে, ন্যাশনাল ডিফেন্স

কলেজের কমান্ড্যান্ট আবু তৈয়ব মোহাম্মদ জহিরুল আলম (জেনারেল জহির নামে ডাকা হয়) দেশের দায়িত্ব নিক। জহির উভয় দল থেকে যোগ্য মন্ত্রী নিয়ে দুই-তিন বছরের জন্য একটি সরকার গঠন করবেন; দুর্বল প্রতিষ্ঠানগুলো উন্নত করা, একটি নতুন সংবিধান তৈরি করা, দুর্নীতি দূর করা এবং বিদেশি বিনিয়োগ আহ্বান করা হবে তার লক্ষ্য; এরপর তিনি আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের উপস্থিতিতে গণতান্ত্রিক নির্বাচনের আয়োজন করবেন।
বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থার জন্য নিজেকেও কিছুটা দায়ী করে নূরউদ্দীন রাষ্ট্রদূতকে বলেন, জেনারেল এরশাদের পতনের সময় তার বন্ধু ও সাবেক সহকর্মী পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল আসলাম বেগ গোপনে দূত পাঠিয়ে তাকে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নিতে বলেছিলেন। নূরউদ্দীন তাতে রাজি না হয়ে আসলামকে অনুরোধ করেছিলেন বিএনপিকে সমর্থন করতে। তখন পাকিস্তান তাদের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইকে ব্যবহার করে বিএনপিকে অর্থের

যোগান দিয়েছিল আর ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ টাকা দিয়েছিল আওয়ামী লীগকে। এ ধরনের অর্থায়ন এখনো চলছে। নূরউদ্দীন বলেন, শেখ হাসিনার কাজকর্মে নয়াদিল্লি অসন্তুষ্ট ছিল এবং ২০০১ সালের নির্বাচনের সময় উভয় দলকেই তারা টাকা দিয়েছে।
রাষ্ট্রদূত এই তারবার্তায় আরও বলেন, গত ১৩ই সেপ্টেম্বর বিএনপির সংসদ সদস্য ও সাবেক সেনাপ্রধান লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান তাকে বলেছিলেন যে, সামরিক বাহিনী অভ্যুত্থান ঘটানোর আগে সবসময়ই যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে একটি সংকেতের অপেক্ষায় থাকবে; ১৯৯৬ সালে সম্ভবত দুটি অভ্যুত্থান ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা ছিল ইতিবাচক। তবে মেজর জেনারেল (অব.) মইনুল হোসেন চৌধুরী রাষ্ট্রদূতকে বলেছেন, সামরিক বাহিনী এমন কিছু করবে না যার ফলে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে তাদের অংশগ্রহণের সুযোগ ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে।

বইয়ের এ তথ্যের ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, হ্যারি কে টমাস তারবার্তায় এসব কথা বলেছেন। ১/১১ নিয়ে আমার বই যখন প্রকাশিত হবে তখন সূত্রের ব্যাপারে বিস্তারিত লেখা হবে।
১/১১ শীর্ষক নিবন্ধে মহিউদ্দিন আহমদ আরো লিখেছেন, নির্বাচনকে ঘিরে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি যখন মুখোমুখি অবস্থানে এবং চারদিকে কেবলই অনিশ্চয়তার অন্ধকার আর সহিংসতার আশঙ্কা, তখন রাজনীতিতে লেখা হচ্ছিল ভিন্ন এক চিত্রনাট্য। মার্কিন রাষ্ট্রদূত প্যাট্রিসিয়া এ বিউটিনেস এবং ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরী ৬ই জানুয়ারি ২০০৭ শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করে বলেন যে, এ ধরনের প্রস্তাবে তাদের সায় নেই এবং অচলাবস্থা কাটাতে দুই নেত্রী সাহসী পদক্ষেপ নিলে এ ধরনের জল্পনাকল্পনার অবসান হবে।

মানবজমিন